আসছে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, কেমন হওয়া উচিত পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষানীতি

শেখ শাহরিয়ার জামান
প্রকাশের সময় : রবিবার, ৭ মে, ২০২৩

শেখ শাহরিয়ার জামান

 

অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। তাই এখন দরকার শক্তিশালী পররাষ্ট্রনীতি ও প্রতিরক্ষানীতি। অর্থনৈতিক গতিশীলতা, দেশের ভৌগোলিক কৌশলগত অবস্থান, সমসাময়িক জটিল ভূ-রাজনীতি ও ভূ-অর্থনীতি বিবেচনা করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র এবং প্রতিরক্ষানীতির মধ্যে আরও বেশি সমন্বয়ের প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলেন, পররাষ্ট্রনীতির বৃহত্তর ফ্রেমে প্রতিরক্ষা কূটনীতির সু্ষ্ঠু প্রয়োগ এখন সময়ের দাবি। পররাষ্ট্রনীতি ও প্রতিরক্ষানীতিকে একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিট বিবেচনা করে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে এর সঠিক মিশ্রণের দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

কূটনীতি ও প্রতিরক্ষা নীতির সমন্বয়
ভারতে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং ইন্ডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের বে অব বেঙ্গল স্টাডিজের পরিচালক তারিক এ করিম বলেন, ‘কূটনীতি এবং প্রতিরক্ষা দুটি ভিন্ন রাস্তা। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য এক। আর সেটি হচ্ছে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। দুটি বিষয়ের ওপর সম্পূর্ণ অধিকার থাকে দেশের এবং দেশ (রাজনৈতিক নেতৃত্ব) ঠিক করে এই দুটির মিশ্রণ কী হবে। এই মিশ্রণটি নির্ভর করে দেশের পরিস্থিতি, ইতিহাস ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর।’

কূটনীতি ও প্রতিরক্ষানীতি যদি একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে তবে এর ফলাফল আরও ভালো হয়। এদের মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে বলে তিনি মনে করেন।

এদিকে, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব এবং দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু চেয়ার মো. শহীদুল হক বলেন, ‘পররাষ্ট্র এবং প্রতিরক্ষা নীতি একটি আরেকটির পরিপূরক। পৃথিবীর অনেক দেশে পররাষ্ট্রনীতি এবং প্রতিরক্ষানীতি অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। কিন্তু আমাদের এখানে এভাবে কম বিবেচনা করা হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে প্রতিরক্ষানীতিকে পররাষ্ট্রনীতির বড় ফ্রেমে কখনও দেখা হয়নি। আমরা বড় হচ্ছি এবং এখন সময় এসেছে বিষয়টিকে বড় ফ্রেমে দেখার এবং বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনার। শহীদুল হক বলেন, ‘আমাদের বুঝতে হবে কোথায় ট্রেড অফ করতে হবে। এর জন্য বৃহত্তর ছবিটার দিকে মনোযোগ দিতে হবে এবং সেটি তখনই দেওয়া সম্ভব হবে যখন সবার মধ্যে সমন্বয় থাকবে।’

দেশ রক্ষা করার জন্য প্রতিরক্ষা
প্রতিরক্ষা কূটনীতিকে পররাষ্ট্রনীতির একটি অংশ হিসেবে বিবেচনা করার জন্য সক্রিয়ভাবে চিন্তা করা দরকার। এখন সময় এসেছে সবাই মিলে বসে পররাষ্ট্রনীতির পুনর্মূল্যায়ন করার। কোথায় আমরা মনোযোগ দেবো এবং কোথায় আমরা সেবা দিতে পারি- এ বিষয়ে তারিক করিম বলেন, ‘আমাদের সামরিক শক্তি আমরা বৃদ্ধি করছি কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য নয়, বরং নিজেদের রক্ষা করার জন্য। আমরা কাউকে আক্রমণ করবো না। কিন্তু কেউ যদি আমাদের ওপর হামলা করে, আমরা ছেড়ে দেবো না। আমাদের ওপর কেউ যদি শক্তি প্রয়োগের চিন্তা করে, তবে তাদের এজন্য অবশ্যই মূল্য দিতে হবে।’

আমাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা অনেক বেড়েছে এবং এটি না ঘটলে আমরা পিছিয়ে যেতাম­– জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের যে উন্নয়ন সেটির ভিত্তি হচ্ছে শান্তি। আমাদের নীতি ‘রক্ষার জন্য প্রতিরক্ষা’ (ডিফেন্সিভ ডিফেন্স), এটি সবাইকে জানাতে হবে।”

তিনি বলেন, রক্ষার জন্য প্রতিরক্ষাটি হবে আমাদের সার্বভৌমত্ব, সম্পদ ও সর্বোপরি মানুষের মঙ্গলের জন্য।

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বলেন, ‘প্রতিরক্ষা নীতির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশের অখণ্ডতা, সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। একইসঙ্গে পররাষ্ট্র নীতির মূল উদ্দেশ্যও একই। এখানে উন্নয়ননীতির সঙ্গে পররাষ্ট্র বা প্রতিরক্ষানীতি একভাবে দেখার সুযোগ নেই।’

সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ সবসময় ‘ডিফেন্সিভ ডিফেন্স’ নীতি অনুসরণ করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এই ন্যারেটিভটি সবাইকে জানালে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি ইতিবাচক বার্তা দেবে।’

তবে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষানীতি পরিচালিত হয় দেশের স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য যা প্রবৃদ্ধি অর্জনে একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরি করে।

জোটে যোগদান
বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে বাংলাদেশের কোনও জোটে যোগ দেওয়ার দরকার নেই। বরং সবার সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান বজায় রেখে পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষানীতির বাস্তবায়ন প্রয়োজন।

তারিক করিম বলেন, ‘যদি ভারতের দিকে তাকাই, তাহলে দেখবো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের ভালো সম্পর্ক। কিন্তু একই সঙ্গে তারা রাশিয়ার সঙ্গে দৃঢ় প্রতিরক্ষা সম্পর্ক বজায় রাখছে। আবার চীনের সঙ্গে তাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক খুব ভালো।’

তিনি বলেন, ‘জোট আমাদের পরিহার করা অবশ্যই দরকার। ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধু অনেক জোট থেকে বের হয়ে আসার কথা বলেছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন যে আমাদের বড় ধরনের সমস্যা হবে।’

যেকোনও জোটে যোগদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দুটি প্রতিবন্ধকতা আছে। এর একটি হচ্ছে এশিয়ায় ভারত-চীন দ্বন্দ্ব এবং দ্বিতীয়টি হলো বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ইন্দো-প্যাসিফিক বনাম বিআরআই (চীন প্রস্তাবিত বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ) বলে তিনি জানান।

শহীদুল হক বলেন, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সম্পর্ক রক্ষা একটি স্বাভাবিক ঘটনা।

ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ সবসময় বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান রক্ষা করে চলে। প্রতিরক্ষা কূটনীতি বাস্তবায়নের সময়ে গাইডিং প্রিন্সিপ্যাল ও লক্ষ্য হবে প্রতিরক্ষানীতি ও পররাষ্ট্রনীতি।’

শান্তিরক্ষা
বাংলাদেশের প্রতিরক্ষানীতির একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে বৈশ্বিক শান্তি রক্ষায় জাতিসংঘকে সহায়তা করে। এছাড়া বিভিন্ন অঞ্চলে দুর্যোগ মোকাবিলায়ও অবদান রাখে বাংলাদেশ।

তারিক করিম বলেন, ‘আমাদের আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষার নীতিটি পূর্বপরিকল্পিতভাবে তৈরি করা হয়নি। এটি বিদেশ থেকে অর্থ উপার্জনের একটি মাধ্যম হিসেবে অনেক ক্ষেত্রে বিবেচিত হয়।’ শান্তিরক্ষা মিশনকে কৌশলগতভাবে ব্যবহারের বিষয়টি গভীরভাবে চিন্তা করা হয়নি বলে নিজের ধারণার কথাও তিনি জানান।

এদিকে শহীদুল হক বলেন, বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ সবসময় অবদান রেখেছে। এছাড়া বিভিন্ন দেশে দুর্যোগ মোকাবিলায় সামরিক বাহিনী ব্যবহার নতুন বিষয় নয়। সম্প্রতি তুরস্কে ভূমিকম্পের পরে ওই দেশে পাঠানো বাংলাদেশের সামরিক দলের অভূতপূর্ব সেবা দেওয়ার কারণে তুরস্কের রাষ্ট্রপতি এরদোয়ান নিজে সার্টিফিকেট দিয়েছেন। এধরনের প্রতিরক্ষা সাফল্যের মধ্যমে সামগ্রিক পররাষ্ট্রনীতিতে বড় ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ

Recent Comments

No comments to show.