ওয়াশিংটননিউজ টিভি,ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ মে ২০২৩ :চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বের অর্থনীতির চেহারা পালটে দিয়েছে। এ অবস্থায় বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ও অভ্যন্তরীণ সামর্থ্য বিবেচনায় নিয়ে বাস্তবতার নিরিখে বাজেট প্রণয়ন করা উচিত।
উচ্চাভিলাষী বাজেট না হওয়াই ভালো। দাম স্বাভাবিক রাখতে নিত্যপণ্য ও কৃষিপণ্যের ওপর কর প্রত্যাহার এবং কৃষি খাতে বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তৌফিক অহমেদ তফছির।
প্রশ্ন : বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ প্রেক্ষাপটে আগামী বাজেট কেমন হওয়া উচিত?
জসিম উদ্দিন : মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিচক্ষণ ও দূরদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে বাংলাদেশ করোনা মহামারি পরিস্থিতি ভালোভাবে সামাল দিয়েছে। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বর্তমানে সারা বিশ্বে একটা মন্দাভাব বিরাজ করছে। এতে একদিকে জ্বালানি ও শিল্পের কাঁচামালের দাম বেড়েছে; অন্যদিকে ইউরোপ ও আমেরিকায় মানুষের কেনার প্রবণতা হ্রাস পাওয়ায় রপ্তানি আয় কমতে শুরু করেছে।
রাজস্ব আয়েও নেতিবাচক প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। তাছাড়া ডলার সংকটে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। এতে শিল্পের কাঁচামাল ও মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে, এটা অর্থনীতির জন্য উদ্বেগজনক। এ বাস্তবতায় বর্তমান পরিস্থিতিতে উচ্চাভিলাষী বাজেট প্রণয়নের যৌক্তিকতা আছে বলে মনে হয় না। সব সময় প্রবৃদ্ধি ধরে বাজেট দিতে হবে, সেটা বাঞ্ছনীয় নয়।
প্রশ্ন : রাজস্ব আয় বাড়ানো যাচ্ছে না কেন?
জসিম উদ্দিন : আমাদের কর-জিডিপি অনুপাত পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় কম। কারণ, রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্র অনেক ছোট। মাত্র দুটি কোম্পানি মোট ভ্যাটের ২০ শতাংশ জোগান দিচ্ছে। অবশিষ্ট ৮০ ভাগ ভ্যাট দিচ্ছে কয়েক লাখ প্রতিষ্ঠান। আয়করের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। মোট আয়করের ৫০ শতাংশের বেশি আসে উৎসে কর খাতে। এক্ষেত্রে এনবিআর-এর তেমন কষ্ট করতে হয় না, বসে বসে আয়কর পাচ্ছে। সারা দেশে রাজস্ব আদায়ের অফুরন্ত সুযোগ থাকলেও এনবিআর নিতে পারছে না।
শুধু যারা কর দিচ্ছে, তাদের ওপরই করের বোঝা চাপানো হচ্ছে। রাজস্ব আদায় বাড়াতে অটোমেশনের বিকল্প নেই। এটা আমরা ১০ বছর ধরে বলে আসছি। কিন্তু কেউ আমলে নেয়নি। এখন আইএমএফ শর্ত দেওয়ায় টনক নড়েছে। অটোমেশন করতে হবে অটোমেশনের মতো। নতুন ভ্যাট আইনের সময় অটোমেশনের কথা বলা হলেও আদৌ কিছুই হয়নি। শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগের ফল শূন্য। আগের নিয়মেই সব চলছে।
প্রশ্ন : এক্ষেত্রে কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে?
জসিম উদ্দিন : ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভাগীয় শহরে ৩ কোটির বেশি হোল্ডিং নম্বর আছে, কমবেশি সবাই হোল্ডিং ট্যাক্স দেয়। অথচ আয়কর রিটার্ন জমা দেয় ৩০ লাখেরও কম। হোল্ডিং নম্বরগুলো ধরে ধরে আয়কর বাড়ানোর সুযোগ আছে। এনবিআর সেখানে যেতে পারছে না। এটা করতে হলে এনবিআর-এর পুনর্গঠন ও সক্ষমতা বাড়ানোর মতো সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
গ্রামীণ অর্থনীতির অনেক বিকাশ ঘটেছে। সেখানেও ট্যাক্স-ভ্যাট দেওয়ার মতো লোক আছে। সেটা করা হচ্ছে না। শুধু করহার বাড়িয়ে আদায় বাড়ানোর প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। হয়রানিমুক্ত এনফোর্সমেন্টের জন্য এনবিআর-এর পলিসি উইং আলাদা করা দরকার।
প্রশ্ন : ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক ঋণনির্ভরতা বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত করবে কি না?
জসিম উদ্দিন : বাংলাদেশের ঋণের পরিমাণ বেশি নয়। এজন্য নিরাপদ ভেবে দেশি (ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান) ও বিদেশিরা (দাতা সংস্থা ও বিদেশি ব্যাংক) সরকারকে ঋণ দিতে চায়। রাজস্ব আদায় ঠিক থাকলে এ ঋণ সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তিনি আরও বলেন, মূল্যস্ফীতি কমাতে আইএমএফ-এর শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংক জুলাইয়ের পর ঋণের সুদের সীমা উঠিয়ে দেওয়ার কথা বলছে।
এটা করলে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। কারণ, বাংলাদেশের অর্থনীতি আর আমেরিকার অর্থনীতি এক নয়। ওই দেশের অর্থনীতি ফরমাল আর আমাদের ইনফরমাল। ৮০ শতাংশ মানুষ ব্যাংকব্যবস্থাতেই নেই। আমাদের সুদহার বাড়ানো মানে পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়ানো, মূল্য বাড়ানো। যারা সুদহার বাজারব্যবস্থার ওপর ছেড়ে দিতে বলছেন, তাদের প্রত্যেকেরই কোনো না কোনো এজেন্ডা আছে।
প্রশ্ন : জ্বালানির অপ্রতুলতা ও মূল্যবৃদ্ধি শিল্পায়ন বাধাগ্রস্ত করছে। আপনি কী মনে করছেন?
জসিম উদ্দিন : আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম বাড়লে দেশে দাম বাড়ানো হয়। কিন্তু কমলে কমানো হয় না। বাংলাদেশে শিল্পায়ন হয়েছে শুধু গ্যাসের ওপর ভর করে। যেসব এলাকায় গ্যাস ছিল, ওইসব জায়গায় শিল্প গড়ে উঠেছে। নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের শর্তে গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ব্যবসায়ীরা মেনে নিয়েছেন। এখন সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ টাকা দিতে হচ্ছে ঠিকই। কারণ হিসাবে বলা হচ্ছে, ডলার সংকটের কথা। সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন না করে দাম বাড়ানো সঠিক হয়নি।
প্রশ্ন : দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধে বাজেটে কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?
জসিম উদ্দিন : ভোজ্যতেল, চিনির মতো আমদানির বিকল্প নেই-এমন নিত্যপ্রয়োজনীয় ও কৃষিপণ্যের ওপর অগ্রিম আয়করসহ সব ধরনের ভ্যাট-ট্যাক্স প্রত্যাহার করা উচিত। এসব পণ্য আমদানিতে যে পরিমাণ রাজস্ব আদায় কম হবে, সেটা অন্য খাত থেকে আদায়ের পরিকল্পনা থাকা দরকার। পাশাপাশি খাদ্য নিরাপত্তায় কৃষিতে বিশেষ নজর দেওয়া উচিত।
চীন, ভিয়েতনামে একই পরিমাণ জমিতে যে ধান উৎপাদন হয়, বাংলাদেশে এর চেয়ে অনেক কম হয়। তাই উন্নত ব্রিড আনতে গবেষণায় জোর দিতে হবে। একসময় মানুষ তো সয়াবিন তেল খেত না, চিনতও না। ধানের উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে সরিষা উৎপাদন কমে গেছে। উন্নত ব্রিডের মাধ্যমে ধানি জমি বাঁচাতে পারলে সেখানে তেলবীজ চাষাবাদ করা যাবে। তখন আমদানিনির্ভরতা কমে আসবে। তার আগ পর্যন্ত দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখতে সরবরাহ পর্যায়ে সব ধরনের করছাড় দিয়ে যেতে হবে।
প্রশ্ন : আইএমএফ-এর শর্ত ব্যবসা-বাণিজ্যে কি প্রভাব ফেলবে?
জসিম উদ্দিন : আইএমএফ-এর প্রেসক্রিপশনে বাংলাদেশ চলবে না বা চালানো যাবে না। তাদের সব কথা শোনা যাবে না। করোনাকালে যখন আমেরিকা নিজের জনগণকে ট্রিলিয়ন ডলার নগদ সহায়তা দিয়েছে, তখন আইএমএফ কোথায় ছিল? এখন তারা জ্বালানি খাতে ভর্তুকির কথা বলছে। উন্নত অনেক দেশ ভর্তুকি দিচ্ছে, সেখানে তারা কিছু বলছে না।
বাংলাদেশের পাট রপ্তানির ওপর ভারত এন্টি ডাম্পিং ডিউটি বসিয়েছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) বিধি অনুযায়ী ভারত এটা পারে না। কিন্তু তাকে তো কেউ কিছু বলছে না। সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে, তবে সেটা করতে হবে বাংলাদেশের স্বার্থ প্রাধান্য দিয়ে।