সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় মহানবীর প্রেরণা

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশের সময় : সোমবার, ১৫ মে, ২০২৩

ওয়াশিংটননিউজ টিভি,  ঢাকা, সোমবার, ১৫ মে ২০২৩ : জীবন বিধান হিসেবে ইসলামের পরিধি ব্যাপক ও সর্বব্যাপী। জীবনের সব ক্ষেত্রে এর সৌরভ ছড়ানো। এ ধারা থেকে সাহিত্য-সংস্কৃতি বাদ যায়নি। জীবনের অন্য সব ক্ষেত্রের মতো সাহিত্য-সংস্কৃতিও এক অপরিহার্য বিষয়। সাহিত্য মানব জীবনের প্রতিচ্ছবি। মানুষের শুভবুদ্ধির উজ্জীবনী শক্তি।

সাহিত্যিকের কাজ মানুষের সুপ্রবৃত্তিকে জাগিয়ে তোলা। মানব মনকে কল্যাণের দিকে উদ্দীপ্ত করা ও মানব-উদ্দীপনার আবহ তৈরি করা। সাহিত্য মানে কল্পলোকের বিস্তার বা সম্মোহনের স্বপ্নজাল নয়। যে সাহিত্য তার সম্মোহনী জালে আত্মবিলীনতার বীজ রোপণ করে, সে সাহিত্য সৎ ও প্রকৃত সাহিত্য নয়।

সংস্কৃতি তো জীবনের ক্ষেত্রে আরও ব্যাপক, আরও গভীর ও অতলস্পর্শী। শোভমানতা ও ঔদার্যে বিভূষিত। জীবনের সাফল্য ও ব্যর্থতার মাপকাঠি। মানুষ কীভাবে আল্লাহ ও তার রাসূল (সা.)-এর নির্দেশিত পথে জীবনের সাফল্য অর্জন করবে, তার চূড়ান্ত লক্ষ্য ‘ইনসানে কামিল’ হওয়ার পথে অগ্রসর হবে- সংস্কৃতি সেই পথনির্দেশক। এক কথায়, সংস্কৃতি হচ্ছে মানব জীবনের চূড়ান্ত সাফল্যের পাথেয়। দ্বীন ও দুনিয়ার মহত্তম সমন্বয়। এর ব্যাপকতাও জীবনের সব ক্ষেত্রে পরিব্যাপ্ত। যে যতো বেশি সংস্কৃতিবান, তিনি ততই পরিশুদ্ধ, পরিচ্ছন্ন ও সফল মানুষ।

মানবজাতির মধ্যে পরম বিশুদ্ধ ও পরিচ্ছন্ন মানুষ হচ্ছেন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল হজরত মুহাম্মদ (সা.)। তিনি ছিলেন এক নয়া সংস্কৃতির নির্মাতা। শুদ্ধতা ও পরিচ্ছন্নতার এক দুর্লভ মহিমায় বিভূষিত। অথচ তার সমাজ ও সময়, তার যুগ ও প্রতিবেশ ছিল পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত। হজরত ঈসা (আ.)কে আসমানে তুলে নেওয়ার পর থেকে তার নবুয়ত প্রাপ্তির আগ পর্যন্ত দীর্ঘদিনব্যাপী মানবসমাজ নিষ্পিষ্ট ছিল পঙ্কিলতা, নির্মমতা, অস্বচ্ছতা, অসততা, অসাধুতা, পৌত্তলিকতা ও পেশিশক্তিমত্তার এক অসহনীয় অনাচার ও দুর্বৃত্তপরায়ণতায়।

এ যুগসন্ধিক্ষণে তার আগমন ঘটে। গোটা মানবমণ্ডলীর কল্যাণকামী হয়ে তিনি যখন দ্বীন প্রচারে লিপ্ত, শত বাঁধা-বিঘ্নের মধ্যেও তিনি ছিলেন অবিচল ও সুদৃঢ়। অথচ তার কোনো শিক্ষক ছিল না। তিনি জাগতিক কোনো পাঠ গ্রহণ করেননি। নবুওয়তের আগে প্রকৃতিই ছিল তার শিক্ষক। তার প্রজ্ঞা, তার বিচক্ষণতা, তার ঔদার্য, তার বিবেচনাবোধ তার সময় ও পরিবেশ থেকে তাকে স্বাতন্ত্র দিয়েছেন। সেই সমাজের সম্মানিত ও মর্যাদাবান পুরুষ হিসেবে, পরিশুদ্ধ ও পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে দুর্লভ সম্মানে তিনি সম্মানিত হয়েছেন। ভাষার শুদ্ধতা, সাংস্কৃতিক পরিচ্ছন্নতা ও মানসিক ঔজ্জ্বল্যে তিনি ছিলেন এক মহিমান্বিত মানুষ।

নবুওয়ত লাভের পর স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার শিক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সে ক্ষেত্রেও তিনি এক প্রজ্ঞাবান, দূরদর্শী, সুচিবেচক, ভারসাম্যপূর্ণ ও পরিপূর্ণ মানুষ। জীবনের কোনো কালিমা তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। পৃথিবীর অগ্নিকুণ্ড থেকে তার মতো এমন অক্ষত অবস্থায় মুক্ত থাকা জীবন মানব ইতিহাসে বিরল। তাই সাহিত্য-সংস্কৃতির মতো জীবনবোধে নিবিষ্ট ও মানুষের সহজাত এবং আত্মলগ্ন জীবনাচরণের সমন্বয়ক উপাদান দুটিও তার স্পর্শে পল্লবিত হয়েছে।

তিনি বলতেন, ‘আমি শুদ্ধতম আরব, কেননা কোরাইশদের ভেতর আমার জন্ম। কিন্তু আমি আমার শৈশব কাটিয়েছি সাদ বিন বকর গোত্রে। তার যুগও ছিল কবিতার ছন্দ-উপমা, শব্দ-উৎপ্রেক্ষা ও বাণী-রূপকল্পে প্লাবিত।

আরবদের জীবন ও জীবিকা, স্বপ্ন ও বাস্তবতা, আশা ও আনন্দ, শত্রুতা ও মিত্রতার বাহন ছিল কবিতা। কবিতা ছিল তাদের ইতিহাস, তাদের বিজ্ঞান, তাদের সংস্কৃতি ও তাদের সভ্যতা। এক কথায় তৎকালীন আরবে কবি ও কবিতা বহুল প্রচলিত ও চর্চিত একটি বিষয় ছিল।

আরবের মানুষের মন ও মনন, আরবের পথ ও প্রান্তর কবি ও কবিতার দ্বারা মেঘমালার মতো আবৃত ছিল।
সেই কাব্যপ্লাবী সমাজের একজন প্রাগ্রসর ও শুদ্ধভাষী মানুষ হয়েও রাসূলুল্লাহ (সা.) নবুওয়তের আগে কোনো কবিতার আসরে যোগ দেননি। যে দু’একবার যোগ দিতে আগ্রহী হয়েছেন, অলৌকিকভাবে পথিমধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছেন বা অন্যভাবে ফিরে এসেছেন। তারপরও যখন তার ওপর নবুওয়তের আসমানি গুরুদায়িত্ব অর্পিত হলো, তখন তাকে শত্রুপক্ষের পক্ষ থেকে বলা হলো ‘কবি’ এবং তার ওপর নাজিলকৃত কিতাব আল-কোরআনকে বলা হলো ‘কবিতা। ’

আল কোরআনই এর প্রতিবাদে সোচ্চার হলো। বলা হলো, ‘আমি রাসূলকে কাব্য রচনা করতে শিখাইনি এবং তা তার জন্য শোভনীয়ও নয়। এ তো কেবল এক উপদেশ এবং সুস্পষ্ট কোরআন। ’ -সূরা ইয়াসিন : ৬৯

এরপরও ইসলামের সৌন্দর্য ও মহিমা প্রচারে আরও অনেক কিছুর মতোই কাফের-মুশরিকরা কবি ও কবিতাকে ব্যবহার শুরু করল। আবু সুফিয়ান ইবনুল হারিছ, আবদুল্লাহ ইবনুয-যিবারা, দিরার ইবনুল খাত্তাব, আমর ইবনুল আস, আবু আয্যা আল জুমাহি, আল হারিছ ইবন হিশাম, হুবায়রা ইবন ওয়াহাব আল-মাখযুমি, মুসাফি ইবন আবদ মানাফ, আবু উসামা মুয়াবিয়া ইবন যুহায়র, কাব ইবন আশরাফ প্রমুখ কবি যখন ইসলামের বিরোধিতায় কবিতা নিয়ে সর্বশক্তিতে নিয়োজিত, তখন কবি ও কবিতা সম্পর্কে ইসলামের নীতি-নির্ধারণী দিকনির্দেশনা জারি হলো। আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে বলা হলো, ‘আর কবিরা, তাদের অনুসরণ করে তো বিভ্রান্তরা। আপনি কি লক্ষ্য করেন না তাদের প্রতি যে, তারা প্রত্যেক প্রান্তরে ঘুরে বেড়ায়? আর তারা তো বলে তা, যা তারা করে না। তবে তারা ছাড়া যারা ঈমান এনেছে, নেক আমল করেছে এবং স্মরণ করেছে আল্লাহকে বারবার আর প্রতিকার করেছে অত্যাচারিত হওয়ার পর শিগগিরই জানবে যারা জুলুম করেছে, কোন জায়গায় তারা ফিরে যাবে। ’ –সূরা শোয়ারা : ২২৪-২২৭

কোরআনে কারিমের এ আয়াতে কবি ও কবিতা তথা সাহিত্য সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। কোরআনের বাচনভঙ্গি, ভাষাশৈলী ও উপস্থাপনা পদ্ধতির কারণে নবদীক্ষিত মুসলিম কবিদের কাছে হঠাৎ ম্লান হয়ে যাওয়া কবিতা আবার নবজীবন লাভ করে। এর সঙ্গে যোগ হয় রাসূলুল্লাহর (সা.) উৎসাহ ও উদ্দীপনা। তার লালন ও পরিশোধন, তার মমত্ব ও ভালোবাসা, তার সহযোগিতা ও সহমর্মিতা। নবুওয়তি দায়িত্ব পালনের ফাঁকে ফাঁকে তিনি সাহাবি-কবিদের কবিতা সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিতেন। তাদের কবিতা শুনতে আগ্রহ প্রকাশ করতেন। তাদের কবিতার শুদ্ধতার প্রতি নজর রাখতেন। তাদের উৎসাহিত করার জন্য পুরস্কৃত করতেন।

সমসাময়িক কবিদের কবিতা সম্পর্কে প্রাজ্ঞ মন্তব্য করতেন। মহানবী (সা.)-এর এসব কথার সারমর্ম ছিল শিল্পকলা তথা সাহিত্যের সৌন্দর্য এবং জীবনের সৌন্দর্যের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা।

এভাবে ইসলামের গৃহাঙ্গনে কবি ও কবিতা স্বতন্ত্র মহিমায় ভাস্বর হয়ে ওঠে। ইসলামের সুমহান সৌন্দর্য প্রচার, কাফের-মুশরিকদের সমুচিত জবাব দেওয়া, নও-মুসলিমদের আত্মত্যাগ ও আত্মশক্তিতে বলীয়ান করার ক্ষেত্রে সাহাবি- কবিদের কবিতা এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।

এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন সাহাবি কবি হজরত হাসসান বিন সাবিত (রা.), হজরত আবদুল্লাহ বিন রাওয়াহা (রা.), হজরত কাব বিন মালিক (রা.), হজরত লবিদ বিন রাহিয়া (রা.) প্রমুখ।

এক পর্যায়ে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজেও তাদের কবিতার বিষয় হয়ে ওঠেন। তার সৌন্দর্যমণ্ডিত জীবন, স্নেহসিক্ত ও দয়ার্দ্র হৃদয়, মানুষের ও মানবতার প্রতি তার অকৃত্রিম ও অভাবনীয় ভালোবাসা সাহাবি-কবিদেরও বিমুগ্ধ করে। তারা কবিতার ভাষায় তার জীবনের নানা দিক উচ্চকিত করে তোলেন। তার ইন্তেকালের পর এ ধারা আরও বিকশিত হয় এবং আরবের সীমানা ছাড়িয়ে দুনিয়ার সব প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। ‘রাসূল-প্রশস্তি’ বা ‘রাসূলের শানে কবিতা’ নামক এই সমুজ্জ্বল ধারা আজ পৃথিবীর সব সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে।

পৃথিবীতে তিনিই হচ্ছেন একমাত্র মানুষ, যাকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর প্রায় সব ভাষার শ্রেষ্ঠ কবিরা মুখরিত হয়েছেন। আরবি, ফার্সি, তুর্কি, ইংরেজি, জার্মানি, ফরাসি, মালয়, উর্দু, হিন্দি ও বাংলা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সব ভাষার সব কবির অনুভূতিতে একই সুর- ‘রুহি ফিদাকা ইয়া রাসূলুল্লাহ!’ হে আল্লাহর রাসূল! আমার সত্তা যেন তোমায় উৎসর্গিত হয়।

এই আবেগ ও ভালোবাসা শুধু কবিতায় নয়, নাটক, গল্প, উপন্যাস- সাহিত্যের প্রায় সব শাখাকে আলোড়িত করেছে এবং আলোকিত করেছে। তার নামের যাদু স্পর্শে অনেক ভাষার গতি পাল্টে গেছে। সমৃদ্ধ হয়েছে সেই ভাষার গাঁথুনি। পরিপুষ্টি পেয়েছে এর অন্তঃসত্ত্বা। বিকশিত হয়েছে ভাব। সমৃদ্ধ হয়েছে শব্দভাণ্ডার। সম্প্রসারিত হয়েছে আবেগ ও উদ্দীপনা, সম্মোহনী শক্তি ও উজ্জীবনী প্রভা। সাহিত্যের সৌন্দর্যের সঙ্গে জীবনের সৌন্দর্যকে একাত্ম করে দিয়েছে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ

Recent Comments

No comments to show.